চুলের শুষ্কতা এর কারণে তেলের ব্যবহার নিয়ে কথা বলতে গেলে মনে পড়ে যায় অতীতের মধুর স্মৃতি। ছোটবেলায় মা যখন চুলে যত্ন আর মমতা দিয়ে তেল দিত তখন ঔ জাদুমাখা হাতের স্পর্শে চুল হয়ে উঠত আরও মসৃণ, উজ্জ্বল আর স্বাস্থ্যকর।
কিন্তু বর্তমানে কর্মব্যস্ততায় সেই প্রাচীন রীতি আর মানা হয় না। বহু মানুষ শ্যাম্পু করার আগেও চুলে তেল দিতে নারাজ। অনেকেই সন্দিহান চুলের শুষ্কতা দূর করতে হেয়ার ওয়েল আসলেই কার্যকরী কি না তা নিয়ে। চলুন আজ বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
চুলের শুষ্কতার কারণ
চুল শুষ্ক হয়ে যাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হলো স্কাল্পে পর্যাপ্ত তেল তৈরি না হওয়া। আমাদের সবার চুলে একটি প্রটেকটিভ লেয়ার থাকে যাকে কিউটিকল বলে। এটি আমাদের চুলকে টানটান রাখে এবং সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি থেকে চুলকে রক্ষা করে। কিন্তু যখন এই কিউটিকল স্তর কোনো কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তখন এটি চুলের জন্য পর্যাপ্ত পরিমান আর্দ্রতা ধরে রাখতে পারে না। ফলে চুল শুষ্ক এবং নিষ্প্রাণ হয়ে পড়ে। কিউটিকল কেনো ক্ষতিগ্রস্ত হয় জানেন? চলুন জেনে নেওয়া যাক।
- চুলে অতিরিক্ত শ্যাম্পু ব্যবহার করলে চুলের জন্য প্রয়োজনীয় প্রাকৃতিক তেল ধুয়ে যায়, যা চুলের আর্দ্রতা কমিয়ে চুল শুষ্ক করে তোলে। প্রতিদিন শ্যাম্পু ব্যবহার না করে সপ্তাহে ২–৩ বার শ্যাম্পু ব্যবহার করলে চুলের প্রাকৃতিক তেল বজায় থাকে।
- গরম পানি দিয়ে চুল ধোয়ার ফলে চুলের প্রাকৃতিক তেল শোষিত হয় এবং চুল শুষ্ক হয়ে যায়। চুল ধোয়ার জন্য নরমাল পানি ব্যবহার করতে হবে।
- শীতল আবহাওয়া, তীব্র গরম বাতাস চুলের আর্দ্রতা কমিয়ে দেয়। উচ্চ তাপমাত্রা চুলের শুষ্কতার একটি বড় কারণ হতে পারে। তাই শীতকালে হালকা তাপমাত্রায় চুল ঢেকে রাখা ভালো।
- চুলে রঙ করা, পার্ম করা বা অন্য কোনো রাসায়নিক প্রক্রিয়া চুলের প্রাকৃতিক তেল নষ্ট করে এবং চুলকে শুষ্ক করে তোলে। রাসায়নিক প্রক্রিয়া থেকে চুলকে যতটা সম্ভব দূরে রাখা উচিত।
- হেয়ার ড্রায়ার, স্ট্রেইটনার বা কার্লিং আয়রনের অতিরিক্ত ব্যবহার চুলের আর্দ্রতা কমিয়ে শুষ্কতা সৃষ্টি করে। হিট না দিয়ে বরং প্রাকৃতিকভাবে চুল শুকানো উচিৎ।
- প্রয়োজনীয় ভিটামিন এবং মিনারেলের অভাবে চুলের স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যার ফলে চুল শুষ্ক হয়ে যায়। স্বাস্থ্যকর খাবার এবং প্রচুর পানি পান করলে চুলের আর্দ্রতা বজায় থাকে।
- অনেকের জেনেটিক বৈশিষ্ট্যের কারণেও চুল শুষ্ক এবং নিষ্প্রাণ থাকে।
এখন আপনার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে চুল শুষ্ক এবং নিষ্প্রাণ হয়ে গেলে করনীয় কি? চলুন জেনে নেই!
চুলের শুষ্কতা দূর করতে তেলের ভুমিকা
চুল শুষ্ক এবং নিষ্প্রাণ হয়ে গেলে সঠিক পদ্ধতিতে তেলের ব্যবহার চুলে পুষ্টি যোগায়। অতিরিক্ত শ্যাম্পু করার ফলে কিউটিকল ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায় তাই শ্যাম্পু করার আগে অবশ্যই চুলে তেল দেওয়া জরুরি। এভাবে শ্যাম্পু করলেও চুলের কিউটিকল নষ্ট হয় না ফলে চুল থাকে মসৃন, উজ্জ্বল এবং স্বাস্থ্যকর। এছাড়াও চুলের শুষ্কতা দূর করতে তেলের ভুমিকা হলো:-
- তেল চুলের আর্দ্রতা ধরে রেখে শুষ্কতা দূর করে। এজন্য নিয়মিত মাথায় নারকেল তেল, অলিভ অয়েল কিংবা অর্গানিক অয়েল ব্যবহার করা জরুরি।
- তেলের মধ্যে থাকা ভিটামিন, মিনারেল এবং ফ্যাটি অ্যাসিড চুলের গোড়া থেকে শিকড় পর্যন্ত পুষ্টি যোগায়। এই উপাদানগুলো চুলের শুষ্কতা কমাতে এবং চুলকে মজবুত রাখতে সাহায্য করে।
- শুষ্ক চুলে ফাটল ধরার প্রবণতা বেশি থাকে। তেল ব্যবহার করলে চুলে ফাটল ধরে না এবং চুল মজবুত ও লম্বা হয়।
- তেল চুলের প্রাকৃতিক উজ্জ্বলতা এবং মসৃণতা ফিরিয়ে আনে। চুলে তেল মাখার ফলে চুল আরও ঝলমলে এবং সুন্দর হয়ে ওঠে।
- তেল চুলের গোড়ায় অর্থাৎ স্কাল্পে মালিশ করার ফলে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পায় যা চুলকে মজবুত করতে সাহায্য করে।
চুলের জন্য কোন কোন তেল সবচেয়ে উপকারী?
চুলের জন্য কোন তেল সবচেয়ে বেশি উপকারী সেটা নির্ভর করে আপনার চুলের ধরনের উপর। তবে নিচের তেলগুলো চুলের শুষ্কতা দূর করতে এবং চুলকে মসৃণ, উজ্জ্বল ও স্বাস্থ্যকর রাখতে সাহায্য করে।
নারকেল তেল: নারকেল তেল অত্যন্ত পুষ্টিকর এবং চুলের শুষ্কতা দূর করতে কার্যকর। এটি চুলের গোড়ায় প্রবেশ করে চলে আর্দ্রতা যোগায়। নারকেল তেল প্রাকৃতিক কন্ডিশনার হিসেবে কাজ করে এবং চুলকে মসৃণ ও উজ্জ্বল করে।
অলিভ অয়েল: অলিভ অয়েল চুলের শুষ্কতা এবং ফাটল প্রতিরোধে কার্যকর। এটি চুলের গোড়ায় পুষ্টি যোগায় এবং চুলকে মজবুত করে। অলিভ অয়েল চুলের প্রাকৃতিক উজ্জ্বলতা বাড়ায় এবং চুলকে স্বাস্থ্যকর রাখে।
আর্গান অয়েল: আর্গান অয়েল চুলের জন্য একটি উপকারী তেল। এটি ভিটামিন ই এবং ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ, যা চুলের শুষ্কতা কমায় এবং আর্দ্রতা বজায় রাখে। আর্গান তেল চুলের মসৃণতা বাড়ায় এবং চুলের গোড়ায় পুষ্টি যোগায়।
জোজোবা ওয়েল: জোজোবা অয়েল চুলের প্রাকৃতিক তেলের সমান, তাই এটি চুলের শুষ্কতা দূর করতে কার্যকর। এটি চুলের আর্দ্রতা ধরে রাখে এবং চুলকে নরম ও মসৃণ করে।
ক্যাস্টর অয়েল: ক্যাস্টর অয়েল চুলের বৃদ্ধির জন্য উপকারী। এটি চুলের গোড়ায় পুষ্টি যোগায় এবং চুলকে মজবুত করে।
উপরে উল্লেখিত অথেনটিক হেয়ার অয়েলগুলো পেতে ক্লিক করুন। Click here!
চুলে তেল দেওয়ার সঠিক পদ্ধতি
চুলে তেল দেওয়ার সময় অবশ্যই কিছু রুলস ফলো করা উচিৎ। যেমন:-
সঠিক তেল নির্বাচন: আপনার চুলের ধরন অনুযায়ী সঠিক তেল নির্বাচন করুন। নারকেল তেল, অলিভ অয়েল, আর্গান তেল, নিম তেল প্রভৃতি বিশেষভাবে কার্যকরী।
পরিষ্কার চুল: তেল লাগানোর আগে চুল পরিষ্কার করে নিন, যাতে তেল ভালোভাবে প্রবেশ করতে পারে।
তেল গরম করুন: তেল হালকা গরম করে ব্যবহার করুন। হালকা গরম তেল চুলের গোড়ায় প্রবেশ করতে সহজ হয়।
ম্যাসাজ: তেল নিয়ে মাথার ত্বকে আলতো করে মালিশ করুন। এটি রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করে। চুলের গোড়া থেকে ডগা পর্যন্ত তেল দিন।
সময়: তেল লাগানোর পর অন্তত ৩০ মিনিট রেখে দিন। রাতে লাগিয়ে সকালে ধুয়ে ফেলতে পারেন। এরপর মাইল্ড শ্যাম্পু দিয়ে তেল ধুয়ে ফেলুন এবং কন্ডিশনার ব্যবহার করুন।
এই পদ্ধতি অনুসরণ করলে চুলের শুষ্কতা কমবে এবং চুল হবে আরও মসৃণ, লম্বা, উজ্জ্বল ও স্বাস্থ্যকর।
বাড়িতে তৈরি হেয়ার অয়েল
চুলের যত্নে বাড়িতে তৈরি হেয়ার অয়েল ব্যবহার করতে পারেন। এখানে একটি সহজ হেয়ার অয়েল রেসিপি দেওয়া হলো:
প্রয়োজনীয় উপকরণ:
- ১ কাপ নারকেল তেল
- ১/২ কাপ অলিভ অয়েল
- ১/৪ কাপ ক্যাস্টর অয়েল
- ১ টেবিল চামচ অর্গান অয়েল
- ১০–১২ টি কারি পাতা
- ২ টি আমলকী (কাটা)
- ৫–৬ টি মেথি দানা
- ১ টেবিল চামচ ভিটামিন ই অয়েল
- ৩–৪ টি জমা ফুল
প্রস্তুত প্রণালী:
একটি পাত্রে নারকেল তেল, অলিভ অয়েল, ক্যাস্টর অয়েল এবং আর্গান অয়েল একসাথে মিশিয়ে নিন। এবার তেলে কারি পাতা, কাটা আমলকী, জবা এবং মেথি দানা যোগ করুন। পাত্রটি হালকা আঁচে গরম করুন, যতক্ষণ না উপকরণগুলি সোনালী রঙ ধারণ করে এবং তেলের মধ্যে তাদের পুষ্টি মিশে যায়।
এবার মিশ্রণটি ঠান্ডা হতে দিন এবং ঠান্ডা হলে একটি পরিষ্কার বোতলে ছেঁকে সংরক্ষণ করুন।
চুলের শুষ্কতা দূর করতে উপরে অনেক পদ্ধতি বর্ননা করা হয়েছে। এছাড়া চুলের আরও খুঁটিনাটি বিষয় জানতে পড়ুন এই ব্লগটি। Click here!
সপ্তাহে কতবার চুলে তেল দেওয়া প্রয়োজন
সাধারণত সপ্তাহে ২–৩ বার চুলে তেল দেওয়া প্রয়োজন। তবে শুষ্ক চুলের ক্ষেত্রে সপ্তাহে ৩–৪ বার তেল দেওয়া উচিৎ। অপরদিকে, তৈলাক্ত চুলের জন্য সপ্তাহে ১–২ বার তেল দেওয়াই যথেষ্ট।
উপসংহার
এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন চুলে তেল দেওয়ার কার্যকারিতা আছে কি নেই। হ্যাঁ, চুলের কিউটিকল ভালো রাখতে অবশ্যই চুলে তেল দেওয়া প্রয়োজন।