তাহাজ্জুদ নামাজ আল্লাহর নৈকট্য লাভের অন্যতম একটি মহৎ ইবাদত। এটি মর্যাদা ও ফজিলতের দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এবং ফরজ নামাজের পরেই এর অবস্থান। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “ফরজ নামাজের পর সর্বশ্রেষ্ঠ নামাজ হলো রাতের (তাহাজ্জুদের) নামাজ।” (মুসলিম) সম্মানিত পাঠক, আজকের ব্লগে আমরা জানবো : তাহাজ্জুদ নামাজের ফজিলত ও গুরুত্ব, কুরআনের আলোকে তাহাজ্জুদের গুরুত্ব, তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম, তাহাজ্জুদ নামাজের সময়, তাহাজ্জুদ নামাজের বাংলা নিয়ত, তাহাজ্জুদ নামাজের আরবি নিয়ত, তাহাজ্জুদ নামাজের সূরা,তাহাজ্জুদ নামাজ সুন্নত নাকি নফল ।
তাহাজ্জুদ নামাজের ফজিলত ও গুরুত্ব :
তাহাজ্জুদ নামাজ আল্লাহ তাআলার কাছে বিশেষভাবে প্রিয় ইবাদত। হাদিসে এসেছে, প্রতি রাতের শেষ তৃতীয়াংশে আল্লাহ তাআলা দুনিয়ার আকাশে নেমে আসেন এবং বলেন, “যে আমাকে ডাকবে আমি তার ডাকে সাড়া দেব। যে আমার কাছে কিছু প্রার্থনা করবে আমি তাকে তা দান করব। যে আমার কাছে ক্ষমা চাইবে আমি তাকে ক্ষমা করে দেব।” (বুখারি, মুসলিম)
কুরআনের আলোকে তাহাজ্জুদের গুরুত্ব:
মহান আল্লাহ রাতের ইবাদতের গুরুত্ব সম্পর্কে কোরআনে ইরশাদ করেছেন: “নিশ্চয়ই রাতের বেলার জাগরণ আত্মসংযমের জন্য অধিক কার্যকর এবং স্পষ্ট কথা বলার জন্য অধিক উপযোগী।” (সুরা মুজ্জাম্মিল: আয়াত ৬)
আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় বান্দাদের গুণাবলী সম্পর্কে বলেছেন: “আর রাহমান-এর বান্দা তারাই, যারা জমিনে অত্যন্ত বিনম্রভাবে চলাফেরা করে এবং যখন জাহেল ব্যক্তিরা তাদেরকে (অশালীন ভাষায়) সম্বোধন করে, তখন তারা বলে, সালাম; আর তারা রাত অতিবাহিত করে তাদের রব-এর উদ্দেশ্যে সিজদাবনত হয়ে এবং দাঁড়িয়ে থেকে।” (সুরা ফুরকান: আয়াত ৬৩-৬৪)
জনপ্রিয় ব্লগ ১ : মেয়েদের ইসলামিক নাম অর্থসহ, ১৯০ + আধুনিক ইসলামিক নাম
জনপ্রিয় ব্লগ ২ : গর্ভবতী হওয়ার লক্ষণ, কিভাবে বুঝবেন ?
জনপ্রিয় ব্লগ ৩ : গর্ভবতী মহিলার গর্ভাবস্থায় বমি হলে কার্যকরী কিছু করণীয় কাজ
জনপ্রিয় ব্লগ ৪ : সিজারের পর মায়ের যত্ন কিভাবে নিবেন
তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম
- তাহাজ্জুদ নামাজ আদায়ের জন্য প্রথমে রাতে কিছু সময় ঘুমানো উত্তম। রাতে ঘুম থেকে উঠে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করা সুন্নাত।
- তাহাজ্জুদ নামাজ একটি নফল ইবাদত, তাই এর জন্য নির্দিষ্ট কোনো রাকাত নেই। আপনি দুই রাকাত থেকে শুরু করে যে কোনো জোড় সংখ্যায় (২, ৪, ৬, ৮ ইত্যাদি) রাকাত আদায় করতে পারেন।
- সাধারণত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ৮ রাকাত তাহাজ্জুদ নামাজ এবং শেষে ৩ রাকাত বিতর নামাজ আদায় করতেন। তবে আপনি নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী ২ রাকাত, ৪ রাকাত, ৬ রাকাত, ৮ রাকাত ইত্যাদি আদায় করতে পারেন।
- তাহাজ্জুদ নামাজে নির্দিষ্ট কোনো সুরা পড়ার বাধ্যবাধকতা নেই। অন্যান্য নামাজের মতোই তাহাজ্জুদ নামাজে সুরা ফাতিহার পর যেকোনো সুরা মিলিয়ে পড়া যায়। তবে নবিজী (সা.) দীর্ঘ সুরা এবং বড় বড় আয়াত দিয়ে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়তেন। এজন্য আমাদেরও চেষ্টা করা উচিত বড় সুরা মুখস্থ করে তা দিয়ে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করা।
- তাহাজ্জুদ নামাজের মূল উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর নৈকট্য লাভ, তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন এবং গভীর রাতে আল্লাহর সাথে একান্তে সময় কাটানো। তাহাজ্জুদ নামাজের ফজিলত অনেক, এবং এটি আত্মিক উন্নতি ও আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়। দীর্ঘ কেরাতে নামাজ পড়া আপনাকে আরও বেশি সময় আল্লাহর ইবাদতে নিয়োজিত থাকতে সাহায্য করে এবং আত্মাকে শান্তি প্রদান করে।
- তাহাজ্জুদ নামাজের বিশেষ কোনো কঠিন নিয়ম নেই, বরং আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে আপনি সহজ ও স্বাভাবিকভাবে এটি আদায় করতে পারেন।
তাহাজ্জুদ নামাজের সময়
- তাহাজ্জুদ নামাজের সময় হলো ইশা নামাজের পর থেকে ফজরের আজানের আগ পর্যন্ত। তবে সর্বোত্তম সময় হলো রাতের শেষ তৃতীয়াংশ।
- রাতকে তিন ভাগে ভাগ করলে:
- প্রথম ভাগ: ইশার নামাজের পর থেকে রাতের এক-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত।
- দ্বিতীয় ভাগ: মধ্যরাত থেকে রাতের দুই-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত।
- তৃতীয় ও শেষ ভাগ: রাতের শেষ তৃতীয়াংশ, যা ফজরের আগের সময়।
- এই শেষ তৃতীয়াংশেই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআ’লা দুনিয়ার আকাশে নেমে আসেন এবং বান্দাদের দোয়া কবুল করেন, পাপ ক্ষমা করেন। তাই এই সময়ে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করা সবচেয়ে ফজিলতপূর্ণ।
- আপনার সুবিধা অনুযায়ী যে কোনো সময়ে তাহাজ্জুদ পড়া যায়, তবে রাতের শেষ তৃতীয়াংশে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করলে এর ফজিলত আরও বেশি।
তাহাজ্জুদ নামাজের বাংলা নিয়ত
- তাহাজ্জুদ নামাজের নির্দিষ্ট কোনো নিয়ত নেই। তবে সহজভাবে বাংলা ভাষায় নিয়ত করতে চাইলে আপনি নিম্নলিখিত নিয়ত করতে পারেন:
- বাংলা নিয়ত:
“আমি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে দুই রাকাত তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করতে চাই, মুখ ফেরালাম কিবলামুখী হয়ে, আল্লাহু আকবার।” - এই নিয়ত মনে মনে করলেই যথেষ্ট। নামাজের জন্য নিয়ত মূলত আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ইবাদত করা, যা অন্তরে স্থির করলেই হয়ে যায়।
তাহাজ্জুদ নামাজের আরবি নিয়ত
- তাহাজ্জুদ নামাজের জন্য আরবি নিয়ত নিম্নরূপ হতে পারে:
- নিয়ত (আরবি)
- উচ্চারণ:
- উছাল্লী সুন্নাতাত তাহাজ্জুদি রাক’আতাইনি লিল্লাহি তাআলা।
- বাংলা অর্থ:
- আমি দুই রাকাত তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ছি আল্লাহর জন্য।
- এই নিয়ত মনে মনে করলেই যথেষ্ট।
তাহাজ্জুদ নামাজের সূরা
তাহাজ্জুদ নামাজে নির্দিষ্ট কোনো সুরা পড়ার বাধ্যবাধকতা নেই। আপনি সুরা ফাতিহার পর যেকোনো সুরা পড়তে পারেন। তবে উত্তম হলো দীর্ঘ সুরা বা লম্বা আয়াত তিলাওয়াত করা। নবিজী (সা.) তাহাজ্জুদ নামাজে সাধারণত বড় বড় সুরা পড়তেন, যেমন সুরা বাকারা, সুরা আলে ইমরান, এবং সুরা নিসা।
- যদি বড় সুরা মুখস্থ না থাকে, তাহলে ছোট সুরা পড়া বা একাধিক ছোট সুরা মিলিয়ে পড়া যেতে পারে। এতে নামাজের কোনো ক্ষতি নেই। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনই তাহাজ্জুদ নামাজের মূল উদ্দেশ্য। সুতরাং আপনি আপনার সাধ্য অনুযায়ী সহজ সুরা দিয়ে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করতে পারেন।
- হজরত আবু হুরায়রা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “ফরজ নামাজের পর সব নফল নামাজের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলো তাহাজ্জুদ নামাজ তথা রাতের নামাজ।” (মুসলিম, তিরমিজি, নাসাঈ)
- এই হাদিসটি স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দেয় যে তাহাজ্জুদ নামাজ আল্লাহর কাছে অত্যন্ত প্রিয় একটি ইবাদত এবং ফরজ নামাজের পর নফল ইবাদতের মধ্যে এটি সর্বোত্তম। আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের জন্য তাহাজ্জুদ নামাজ আদায়ের বিশেষ ফজিলত রয়েছে।
কিছু প্রস্তাবিত সুরা:
- সুরা ইখলাস
- সুরা ফালাক
- সুরা নাস
- সুরা কাফিরুন
- সুরা ফাতিহা
- তাহাজ্জুদ নামাজের মূল বিষয় হলো একাগ্রতা ও আন্তরিকতা। আপনি যা সহজে পড়তে পারেন, সেটাই আদায় করুন এবং আল্লাহর কাছে দোয়া ও প্রার্থনা করুন।
- তাহাজ্জুদ নামাজ সুন্নত নাকি নফল
আলেমদের মতে, তাহাজ্জুদ নামাজ সুন্নতে গায়রে মুয়াক্কাদা বা নফল ইবাদত। এটি ফরজ বা সুন্নতে মুয়াক্কাদার মতো বাধ্যতামূলক নয়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে তাহাজ্জুদ নামাজের বিভিন্ন রাকাত সংখ্যা প্রমাণিত হয়েছে—চার, ছয়, আট, ১০ বা তারও বেশি। যেহেতু এটি নফল ইবাদত, তাই যে কোনো সংখ্যায় পড়া যায়। তবে আলেমদের মতে, আট রাকাত পড়া সর্বোত্তম এবং এটি নবীজি (সা.)-এর প্রিয় আমল ছিল।
- তাহাজ্জুদ নামাজের মূল উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর নৈকট্য অর্জন এবং তার সন্তুষ্টি লাভ করা, তাই যার যতোটা সামর্থ্য, সেই অনুযায়ী এই ইবাদত আদায় করতে পারেন।
- রাতের শেষ প্রহরে আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করে ক্ষমা চাওয়া এবং ইবাদত করা খাঁটি ঈমানদারদের একটি বিশেষ গুণ। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন: “তারা ধৈর্যশীল, সত্যবাদী, অনুগত, ব্যয়কারী এবং রাতের শেষ প্রহরে ক্ষমাপ্রার্থী।”(সুরা আলে ইমরানের আয়াত ১৭)
- এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা ঈমানদারদের কিছু বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন, যার মধ্যে রাতের শেষ প্রহরে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা একটি বিশেষ গুণ হিসেবে বর্ণিত হয়েছে।
- আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে আরও বলেন
- “আর রাতের কিছু অংশে তাহাজ্জুদ পড় (ইবাদত হিসেবে); এটি তোমার জন্য অতিরিক্ত দায়িত্ব। অচিরেই তোমার রব তোমাকে প্রশংসিত স্থানে প্রতিষ্ঠিত করবেন।” (সুরা বনি ইসরাঈল, আয়াত: ৭৯)
- এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা বিশেষভাবে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন। এটি নবীজির জন্য ফরজ ছিল এবং তার উম্মতের জন্য এটি নফল ইবাদত হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। আল্লাহ এ ইবাদতের মাধ্যমে তার প্রিয় বান্দাদের প্রতি বিশেষ দয়া ও মর্যাদা দান করেন।
- আয়াতে বলা হয়েছে যে, এই ইবাদতের বিনিময়ে আল্লাহ তার প্রিয় বান্দাকে “মাকামে মাহমুদ” (প্রশংসিত স্থান) প্রদান করবেন, যা হলো কিয়ামতের দিন নবীজির জন্য নির্ধারিত বিশেষ মর্যাদার স্থান।
- তাহাজ্জুদ নামাজের সময় আল্লাহর দরবারে চোখের পানি ফেলা, নিজের গুনাহের জন্য ক্ষমা চাওয়া, এবং আন্তরিকভাবে আল্লাহর কাছে দোয়া করা একজন খাঁটি মুমিনের পরিচয়। আল্লাহ তাআলা রাতের শেষ প্রহরে তার বান্দাদের দোয়া কবুল করেন এবং তাদের প্রতি বিশেষ রহমত বর্ষণ করেন।
- এ কারণে তাহাজ্জুদ নামাজ ও ক্ষমা প্রার্থনা ঈমানদারদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত এবং তা আল্লাহর কাছে অত্যন্ত প্রিয়।
উপসংহার:
তাহাজ্জুদ নামাজ হলো একান্ত নৈশ ইবাদত, যা আল্লাহর নৈকট্য লাভের অন্যতম মাধ্যম। এই নামাজের মাধ্যমে আমরা আল্লাহর বিশেষ রহমত ও দয়া লাভ করতে পারি। কুরআন ও হাদিসে এর ফজিলত ও গুরুত্ব স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর প্রশংসা করতেন এবং তার উম্মতকেও এই ইবাদতের প্রতি উৎসাহিত করেছেন।
তাহাজ্জুদ নামাজ শুধু আল্লাহর সাথে সম্পর্ক দৃঢ় করে না, বরং আমাদের জীবনে আধ্যাত্মিক শক্তি ও আত্মবিশ্বাস যোগায়। এটি আমাদের মন ও হৃদয়ে প্রশান্তি এনে দেয় এবং দুনিয়ার ব্যস্ততার মধ্যে আল্লাহর স্মরণে লীন থাকার এক অনন্য সুযোগ সৃষ্টি করে। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ এবং দোয়া কবুলের জন্য তাহাজ্জুদ নামাজের কোনো তুলনা নেই। তাই আমাদের উচিত, এই মহিমান্বিত ইবাদতকে জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে গ্রহণ করা এবং নিয়মিত তাহাজ্জুদ আদায়ের অভ্যাস গড়ে তোলা।
আল্লাহ আমাদের সকলকে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করার তাওফিক দান করুন এবং এর বরকত দ্বারা আমাদের জীবন আলোকিত করুন। আমিন।